ওয়াশিংটন সুন্দর: বহুমুখী প্রতিভার উত্থান এবং ভারতীয় ক্রিকেটে তার প্রভাব

Oct 23, 2025 by miodeya.com 110 views

ওয়াশিংটন সুন্দর: বহুমুখী প্রতিভার উত্থান এবং ভারতীয় ক্রিকেটে তার প্রভাব

ওয়াশিংটন সুন্দরের প্রারম্ভিক জীবন ও ক্রিকেট শুরুর গল্প

ওয়াশিংটন সুন্দর, ভারতীয় ক্রিকেটের এক বহুমুখী প্রতিভাধর তারকা, যার জীবনের গল্পটি তার খেলার মতোই অনুপ্রেরণামূলক। চেন্নাইয়ের এক সাধারণ পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল, কিন্তু তাঁর নামের পেছনে লুকিয়ে আছে এক গভীর কৃতজ্ঞতার গল্প। তাঁর বাবা এম. সুন্দর, যিনি একসময় নিজেও একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ক্রিকেটার ছিলেন কিন্তু আর্থিক এবং অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কারণে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি, তিনি তাঁর অন্ধ গুরু ‘পিডি ওয়াশিংটন’-এর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুত্রের নাম রাখেন ‘ওয়াশিংটন’। এই গুরুই সুন্দর পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করেছিলেন এবং এম. সুন্দরকে ক্রিকেট খেলার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। এই নাম কেবল একটি পরিচয় নয়, এটি স্মৃতি এবং কৃতজ্ঞতার এক চিরন্তন প্রতীক। শৈশব থেকেই ওয়াশিংটন সুন্দরের রক্তে ছিল ক্রিকেটের নেশা। ছোটবেলা থেকেই ব্যাট এবং বল ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। চেন্নাইয়ের স্থানীয় ক্রিকেট একাডেমি এবং ক্লাবগুলোতে তাঁর নিয়মিত উপস্থিতি দেখা যেত, যেখানে তাঁর অফ-স্পিন বোলিংয়ের দক্ষতা এবং ঠান্ডা মাথার ব্যাটিং শৈলী খুব দ্রুত সকলের নজর কেড়েছিল। বিশেষ করে, পাওয়ারপ্লেতে তাঁর আঁটসাঁট বোলিং এবং উইকেট নেওয়ার ক্ষমতা তাঁকে সতীর্থ এবং কোচদের মধ্যে আলাদা করে তুলেছিল। তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লিগ (টিএনপিএল) এবং অন্যান্য ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোতে তাঁর ধারাবাহিক পারফরম্যান্স তাকে দ্রুত জাতীয় স্তরে পরিচিতি এনে দেয়। মাত্র ১৫ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ, যা তাঁর অসাধারণ প্রতিভার একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত। এই বয়সে এত বড় মঞ্চে খেলার সুযোগ পাওয়া এবং সাফল্য অর্জন করা, তা কেবল কঠোর পরিশ্রমের ফল ছিল না, বরং তাঁর ক্রিকেটীয় বুদ্ধিমত্তা এবং চাপের মুখে শান্ত থাকার ক্ষমতাও এর পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। ওয়াশিংটনের বাবা সর্বদা তাঁর পাশে ছিলেন, একজন পরামর্শদাতা এবং সমর্থক হিসেবে। তিনিই তাঁর প্রশিক্ষণে সহায়তা করতেন এবং নিশ্চিত করতেন যেন ওয়াশিংটন সঠিক পথে এগোয়। এই সমর্থন ওয়াশিংটনকে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে সাহায্য করেছে। ওয়াশিংটন সুন্দরের এই প্রারম্ভিক জীবনই তার ভবিষ্যতের সাফল্যের বীজ বুনে দিয়েছিল, যা তাকে একজন পূর্ণাঙ্গ অলরাউন্ডার হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। তাঁর শুরুর দিনগুলো ছিল চ্যালেঞ্জে ভরা, কিন্তু প্রতিটি বাধা তাঁকে আরও শক্তিশালী করেছে। এই তরুণ প্রতিভা ভারতের পরবর্তী প্রজন্মের ক্রিকেটারদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এবং তাঁর গল্পটি প্রমাণ করে যে আবেগ, কঠোর পরিশ্রম এবং সঠিক দিকনির্দেশনা থাকলে যেকোনো স্বপ্নই অর্জন করা সম্ভব।

ঘরোয়া ক্রিকেট ও আইপিএলে ওয়াশিংটন সুন্দরের উত্থান

ওয়াশিংটন সুন্দরের ক্রিকেটীয় যাত্রা শুধু আন্তর্জাতিক মঞ্চেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ঘরোয়া ক্রিকেট এবং ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) তাঁর প্রতিভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করেছে। তামিলনাড়ুর হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর পারফরম্যান্স ছিল চোখে পড়ার মতো। লিস্ট এ এবং টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তাঁর ধারাবাহিকতা তাঁকে নির্বাচকদের নজরে এনেছিল। বিশেষ করে, ব্যাঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত ২০১৭ সালের বিজয় হাজারে ট্রফিতে তাঁর অলরাউন্ড পারফরম্যান্স ছিল এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সেখানে তিনি ব্যাট হাতে মূল্যবান রান সংগ্রহ করার পাশাপাশি বল হাতেও উইকেট তুলে নেন, যা তামিলনাড়ুকে ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছাতে সাহায্য করে। ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর এই অসাধারণ প্রদর্শনীই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) দরজা খুলে দেয়। আইপিএলে ওয়াশিংটন সুন্দরের আগমন হয় অপ্রত্যাশিতভাবে। ২০১৭ সালে তিনি রাইজিং পুনে সুপারজায়ান্টসের (আরপিএস) হয়ে খেলার সুযোগ পান। সেই মৌসুমে তাঁর বোলিং ছিল টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা আবিষ্কার। তিনি পাওয়ারপ্লেতে মাত্র ৬.১৬ ইকোনমি রেটে বোলিং করে সবাইকে চমকে দেন, যা একজন স্পিনারের জন্য অবিশ্বাস্য। এই পারফরম্যান্স তাকে বিরাট কোহলির নেতৃত্বাধীন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু (আরসিবি) দলের সদস্য হতে সাহায্য করে। আরসিবিতে তাঁর ৪ বছরের যাত্রা ছিল উত্থান-পতনের মিশ্রণ। তিনি ব্যাট হাতেও কিছু ঝলক দেখিয়েছেন, বিশেষ করে কঠিন পরিস্থিতিতে দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রান করেছেন। তবে, চোটের কারণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ থেকে তাকে ছিটকে যেতে হয়েছে, যা তার ধারাবাহিকতাকে কিছুটা ব্যাহত করেছে। পরবর্তীতে, ২০২২ সালের মেগা নিলামে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ (এসআরএইচ) তাকে বিপুল অঙ্কে দলে নেয়। এসআরএইচ-এর হয়ে ওয়াশিংটন সুন্দর আরও বেশি সুযোগ পান নিজেকে একজন অলরাউন্ডার হিসেবে প্রমাণ করার। এখানে তিনি কেবল স্পিন বোলিংই করেননি, বরং লোয়ার অর্ডারে নেমে দ্রুত রান তোলার ক্ষমতাও দেখিয়েছেন। তাঁর আক্রমণাত্মক ব্যাটিং এবং কৌশলী বোলিং তাঁকে দলের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তোলে। আইপিএল তাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছে, যেখানে তিনি বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের বিরুদ্ধে খেলার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। আইপিএলের এই অভিজ্ঞতা ওয়াশিংটনকে আন্তর্জাতিক চাপ সামলানোর জন্য প্রস্তুত করেছে এবং তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। তাঁর এই উত্থান প্রমাণ করে যে, ধারাবাহিক পারফরম্যান্স এবং সঠিক সুযোগ পেলে একজন খেলোয়াড় কীভাবে নিজের পরিচিতি গড়ে তুলতে পারে। ঘরোয়া ক্রিকেট এবং আইপিএল ওয়াশিংটন সুন্দরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের মূল ভিত্তি স্থাপন করেছে, যা তাকে একজন সম্পূর্ণ প্যাকেজ অলরাউন্ডার হিসেবে গড়ে তুলেছে।

টি-টোয়েন্টি বিশেষজ্ঞ: ওয়াশিংটন সুন্দরের আন্তর্জাতিক অভিষেক ও তার দক্ষতা

ওয়াশিংটন সুন্দরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ হয় টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে, যেখানে তিনি খুব দ্রুত নিজেকে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাঁর টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক (টি-২০আই) অভিষেক হয়। এই ফরম্যাটে তাঁর প্রধান অস্ত্র ছিল পাওয়ারপ্লেতে মিতব্যয়ী বোলিং করা এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেট তুলে নেওয়া। অফ-স্পিনার হিসেবে তিনি নতুন বলে যেভাবে ব্যাটসম্যানদের রান তুলতে বাধা দিতেন, তা ছিল এক অসাধারণ দক্ষতা। তাঁর বোলিং অ্যাকশন ছিল সাবলীল এবং বলের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল অবিশ্বাস্য। কেবল বোলিং নয়, ব্যাট হাতেও তিনি কিছু ঝলক দেখিয়েছেন, বিশেষ করে লোয়ার অর্ডারে দ্রুত রান করে দলের স্কোর বাড়াতে সাহায্য করেছেন। ওয়াশিংটন সুন্দরের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা মুহূর্ত আসে ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত নিদাহাস ট্রফিতে। এই টুর্নামেন্টে তিনি পাওয়ারপ্লেতে অসাধারণ বোলিং করে সকলের নজর কাড়েন এবং টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জেতেন। ফাইনালে বাংলাদেশের বিপক্ষে তাঁর শান্ত মেজাজের বোলিং এবং উইকেট নেওয়ার ক্ষমতা ভারতের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই টুর্নামেন্টের পর তিনি ভারতীয় টি-টোয়েন্টি দলের একজন নিয়মিত সদস্য হয়ে ওঠেন। তার ইকোনমি রেট ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়, যা টি-টোয়েন্টির মতো আক্রমণাত্মক ফরম্যাটে খুবই বিরল। তিনি দলের জন্য এমন একজন বোলার ছিলেন, যিনি ম্যাচের মোমেন্টাম পাল্টে দিতে পারতেন। তাঁর ঠান্ডা মাথার বোলিং এবং পরিস্থিতি বুঝে খেলার ক্ষমতা তাকে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে একজন মূল্যবান সম্পদ করে তুলেছে। সময়ের সাথে সাথে তাঁর ব্যাটিংও আরও উন্নত হয়েছে, যা তাঁকে একজন সত্যিকারের অলরাউন্ডার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তাঁর এই সাফল্য কেবল তার কঠোর পরিশ্রমেরই ফল নয়, বরং তাঁর কৌশলগত চিন্তাভাবনা এবং চাপের মুখে শান্ত থাকার ক্ষমতারও প্রমাণ। ওয়াশিংটন সুন্দর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এমন একজন খেলোয়াড়, যিনি দলের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। নতুন বল হাতে ব্রেকথ্রু দেওয়া থেকে শুরু করে, মাঝের ওভারে রান আটকে রাখা এবং শেষে ব্যাট হাতে দ্রুত রান যোগ করা—সবকিছুতেই তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তার টি-টোয়েন্টি দক্ষতা তাকে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডারদের কাতারে নিয়ে এসেছে, যা ভারতীয় দলকে এই ফরম্যাটে আরও শক্তিশালী করেছে।

টেস্ট ক্রিকেটে বীরত্ব: অস্ট্রেলিয়ায় সুন্দরের স্মরণীয় অভিষেক

ওয়াশিংটন সুন্দরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় এবং ঐতিহাসিক অধ্যায়গুলোর মধ্যে একটি হলো তাঁর টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক। ২০২০-২১ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরের কথা উঠলেই গাভাস্কার-বর্ডার ট্রফিতে ভারতের ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের কথা মনে পড়ে, যেখানে এই তরুণ অলরাউন্ডার এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। অসংখ্য সিনিয়র খেলোয়াড়ের ইনজুরির কারণে দলে ডাক পেয়েছিলেন তিনি, এবং অভিষেক টেস্টে তিনি যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন, তা কেবল তাঁর ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারের জন্যই নয়, ভারতীয় ক্রিকেটের জন্যও ছিল এক মাইলফলক। ব্রিসবেনের গাব্বায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ টেস্টে তাঁর অভিষেক হয়, যা ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। অস্ট্রেলিয়ার ফাস্ট বোলারদের মুখোমুখি হয়ে তিনি ব্যাট হাতে গুরুত্বপূর্ণ ৮৪ রানের একটি জুটি গড়েন শার্দুল ঠাকুরের সাথে, যা ভারতকে এক সম্মানজনক স্কোরে পৌঁছাতে সাহায্য করে। তিনি নিজে ৬২ রানের এক অনবদ্য ইনিংস খেলেন, যা ছিল একজন অভিষিক্ত খেলোয়াড়ের জন্য এক অসাধারণ কীর্তি। এই ইনিংসে তিনি দেখিয়েছিলেন তার ধৈর্য, কৌশল এবং আগ্রাসন, যা টেস্ট ক্রিকেটের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। কেবল ব্যাটিংই নয়, বল হাতেও ওয়াশিংটন সুন্দর নিজের ছাপ রাখতে সক্ষম হন। তিনি স্টিভ স্মিথ এবং ক্যামেরন গ্রিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটসম্যানদের উইকেট তুলে নিয়েছিলেন, যা অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইনআপে চাপ সৃষ্টি করে। তাঁর অফ-স্পিন বোলিংয়ে ছিল নিয়ন্ত্রণ এবং বৈচিত্র্য, যা অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের জন্য কঠিন পরীক্ষা ছিল। দ্বিতীয় ইনিংসেও তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ রান যোগ করে ভারতের জয়ে অবদান রাখেন। গাব্বার এই ঐতিহাসিক টেস্টে ওয়াশিংটন সুন্দরের পারফরম্যান্স তাকে রাতারাতি জাতীয় হিরোতে পরিণত করে। এটি ছিল এমন একটি ম্যাচ যেখানে ভারতের তরুণ এবং অনভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছিল, আর ওয়াশিংটন সুন্দর ছিলেন সেই ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই পারফরম্যান্স কেবল তাঁর আত্মবিশ্বাসই বাড়ায়নি, বরং টেস্ট ক্রিকেটে একজন অলরাউন্ডার হিসেবে তাঁর সম্ভাবনাকেও উজ্জ্বল করে তুলেছে। অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর এই বীরত্বপূর্ণ অভিষেক প্রমাণ করে যে, তিনি কেবল সীমিত ওভারের ফরম্যাটের জন্যই নন, দীর্ঘ ফরম্যাটেও তিনি একজন অপরিহার্য খেলোয়াড় হতে পারেন। গাব্বার সেই জয় ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, আর তার সাথে উজ্জ্বল থাকবে ওয়াশিংটন সুন্দরের নাম।

ওয়ানডেতে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও চ্যালেঞ্জ: ৫০ ওভারের ফরম্যাটে ওয়াশিংটন সুন্দরের যাত্রা

ওয়াশিংটন সুন্দরের ক্রিকেটীয় দক্ষতা কেবল টি-টোয়েন্টি বা টেস্ট ক্রিকেটে সীমাবদ্ধ নয়, তিনি ৫০ ওভারের ফরম্যাট অর্থাৎ ওয়ানডে ক্রিকেটেও নিজের ছাপ ফেলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর অলরাউন্ড দক্ষতা – বিশেষ করে বুদ্ধিদীপ্ত অফ-স্পিন বোলিং এবং ঠান্ডা মাথার ব্যাটিং – ওয়ানডে ফরম্যাটের জন্য তাঁকে একজন উপযুক্ত খেলোয়াড় হিসেবে তুলে ধরেছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই তাঁর ওয়ানডে অভিষেক হয়, টি-টোয়েন্টি অভিষেকের ঠিক পরে। তবে, টি-টোয়েন্টি এবং টেস্টের তুলনায় ওয়ানডে ফরম্যাটে তাঁর যাত্রা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। প্রথম দিকে তিনি নিয়মিত সুযোগ পাননি, কারণ ভারতীয় দলে অভিজ্ঞ স্পিনার এবং অলরাউন্ডারদের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু যখনই তিনি সুযোগ পেয়েছেন, নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ওয়ানডে ফরম্যাটে তাঁর প্রধান ভূমিকা ছিল মাঝের ওভারে রান আটকে রাখা এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্রেকথ্রু এনে দেওয়া। তাঁর মিতব্যয়ী বোলিং ক্ষমতা এবং ব্যাটসম্যানদের উপর চাপ সৃষ্টি করার কৌশল এই ফরম্যাটের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাট হাতে তিনি লোয়ার অর্ডারে নেমে দ্রুত রান যোগ করতে পারতেন, যা দলের ইনিংসকে মজবুত করতে সাহায্য করত। ওয়াশিংটন সুন্দরের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ধারাবাহিক ইনজুরি। বিভিন্ন সময়ে চোটের কারণে তাঁকে দলের বাইরে থাকতে হয়েছে, যা তাঁর ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে বাধা সৃষ্টি করেছে। হ্যামস্ট্রিং ইনজুরি, হাতের চোট এবং কোভিড-১৯ সংক্রমণ তাকে বেশ কয়েকবার মাঠের বাইরে ঠেলে দিয়েছে, যার ফলে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ এবং টুর্নামেন্ট মিস করেছেন। এই ইনজুরিগুলো তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের গতি কিছুটা মন্থর করে দিয়েছে। তবে, প্রতিটি আঘাত থেকে ফিরে আসার জন্য তাঁর সংকল্প ছিল অটুট। তিনি কঠোর পরিশ্রম করে ফিটনেস ফিরে পেয়েছেন এবং বারবার দলে ফেরার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশ এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কিছু ম্যাচে তিনি ব্যাট ও বল হাতে দারুণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে নিজের সক্ষমতা প্রমাণ করেছেন। বিশেষ করে, চাপের মুখে তাঁর ব্যাটিং এবং কঠিন পরিস্থিতিতে উইকেট নেওয়া, তাঁকে একজন মূল্যবান সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত করে। ৫০ ওভারের ফরম্যাটে ওয়াশিংটন সুন্দরের সম্ভাবনা অপরিসীম, যদি তিনি ইনজুরি থেকে মুক্ত থাকতে পারেন এবং নিয়মিত সুযোগ পান। তাঁর শান্ত মেজাজ, ক্রিকেটীয় বুদ্ধি এবং অলরাউন্ড ক্ষমতা তাঁকে ভারতীয় ওয়ানডে দলে এক স্থায়ী সদস্য হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

ওয়াশিংটন সুন্দরের অনন্য শৈলী ও তার শক্তির দিক

ওয়াশিংটন সুন্দর, ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর স্বতন্ত্র খেলার ধরণ এবং বহুমুখী দক্ষতার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর ক্রিকেটীয় শৈলী তাঁকে সমসাময়িক খেলোয়াড়দের থেকে আলাদা করে তুলেছে এবং ভারতীয় দলের জন্য এক বিশেষ সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর প্রধান শক্তির দিকগুলো হলো – বুদ্ধিদীপ্ত অফ-স্পিন বোলিং, ঠান্ডা মাথার ব্যাটিং এবং অসাধারণ ফিল্ডিং। প্রথমেই আসি তাঁর বোলিং নিয়ে। ওয়াশিংটন একজন ডানহাতি অফ-স্পিনার, যিনি পাওয়ারপ্লে এবং ডেথ ওভারে মিতব্যয়ী বোলিং করার জন্য সুপরিচিত। তাঁর মূল বৈশিষ্ট্য হলো বলের ওপর চমৎকার নিয়ন্ত্রণ এবং লেন্থ ও লাইনের ধারাবাহিকতা। তিনি খুব বেশি স্পিন করার চেয়ে ব্যাটসম্যানদের গতি পরিবর্তন এবং নির্ভুল লাইন-লেন্থ দিয়ে ভুল করতে বাধ্য করেন। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তাঁর এই দক্ষতা সবচেয়ে বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে, যেখানে তাঁর ইকোনমি রেট প্রায়শই অসাধারণ থাকে। নতুন বল হাতে নিয়ে তিনি সুইং করাতে পারেন এবং পাওয়ারপ্লেতে উইকেট নেওয়ার ক্ষমতা তাঁকে দলের জন্য অপরিহার্য করে তোলে। মাঝের ওভারেও তিনি রান আটকে রাখতে পারদর্শী, যা প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের উপর চাপ সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, তাঁর ব্যাটিং দক্ষতা। ওয়াশিংটন সুন্দর একজন বামহাতি ব্যাটসম্যান, যিনি লোয়ার অর্ডারে নেমে আক্রমণাত্মক এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাটিং করতে সক্ষম। তাঁর ব্যাটিং স্টাইল শান্ত এবং সাবলীল। চাপের মুখেও তিনি মাথা ঠান্ডা রেখে ব্যাট করতে পারেন, যা অস্ট্রেলিয়ার গাব্বা টেস্টে তাঁর ঐতিহাসিক ইনিংসে স্পষ্ট দেখা গেছে। তিনি কেবল বাউন্ডারি হাঁকাতে পারেন না, বরং স্ট্রাইক রোটেট করে ইনিংস গড়তেও পটু। লম্বা ইনিংস খেলার ক্ষমতা এবং দ্রুত রান তোলার মিশ্রণ তাঁকে একজন সম্পূর্ণ প্যাকেজ ব্যাটসম্যান হিসেবে গড়ে তুলেছে। দলের যখন প্রয়োজন হয়, তিনি তখন বড় শট খেলতে দ্বিধা করেন না, যা আধুনিক ক্রিকেটে একজন অলরাউন্ডারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়ত, তাঁর ফিল্ডিং। ওয়াশিংটন সুন্দর একজন অসাধারণ ফিল্ডার। কভার, পয়েন্ট বা থার্ড ম্যান – যেকোনো স্থানেই তাঁর ক্ষিপ্রতা এবং বলের প্রতি মনোযোগ চোখে পড়ার মতো। তিনি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাচ ধরতে এবং রান আউট করতে সিদ্ধহস্ত, যা দলের ফিল্ডিংয়ে বাড়তি মাত্রা যোগ করে। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া দলকে অনেক মূল্যবান রান বাঁচিয়ে দেয়। এই তিন স্তরের দক্ষতা ওয়াশিংটন সুন্দরকে একজন প্রকৃত অলরাউন্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শান্ত স্বভাব এবং চাপের মুখে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার ক্ষমতা ভারতীয় দলকে অনেক কঠিন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করেছে। এই অনন্য শৈলীই ওয়াশিংটন সুন্দরকে ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ তারকাদের মধ্যে এক উজ্জ্বল স্থানে রেখেছে। তাঁর বহুমুখী দক্ষতা এবং খেলার প্রতি তার নিষ্ঠা তাকে ভারতীয় দলের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলেছে এবং তাঁর উপস্থিতি যেকোনো ফরম্যাটে দলের ভারসাম্য বাড়ায়।